ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ওঠানামা করছে রাজনীতির পারদ। তবে ভোটের আলোচনায় আসতেই ঘুরেফিরে কোনো না কোনোভাবে আসছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগেরও নাম। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশের রাজনীতিতে দলটি ফের সক্রিয় হওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে হয়েছে নানা বিতর্ক। এমনকি মূল নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের আলোচনাও উঠেছে এই সময়ে।
নতুন করে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক এই আলোচনায় উত্তাপ আরও বাড়িয়েছে। দলটির পলাতক নেতারা সরাসরি এ বিষয়ে কিছু স্বীকার না করলেও দলকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে যেকোনো প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দ্বিমত করেননি।
জানা গেছে, গত সোমবার রাজধানীর গুলশানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নিজ বাসভবনে অতি গোপনীয়ভাবে তিনটি দেশের রাষ্ট্রদূত বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে। এতে অংশ নেন তিনজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত। তারা হলেনÑঢাকায় নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন আরাল্ড গুলব্রানসেন, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিনাস রাগনার উইকস এবং ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মলার। ওই বৈঠকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দল আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে কূটনীতিকরা জানতে চান সাবের হোসেন চৌধুরীর কাছে। এ ছাড়া কীভাবে দলটির কার্যক্রম ফের শুরু করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়। নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকরা বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সদস্যদের যদি বর্তমান সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় তা হলে বিদেশি কূটনীতিকদের তাতে তেমন কোনো আপত্তি নেই বলেও ওই বৈঠকে জানান।
সূত্র জানায়, এই তিন রাষ্ট্রদূত ফ্ল্যাগ ছাড়া অর্থাৎ কোনো কূটনৈতিক স্বাক্ষর ছাড়াই একই গাড়িতে চড়ে সাবের হোসেনের বাসভবনে যান। নজর এড়াতে তারা বৈঠক শেষে বাসভবনটি থেকে বেরিয়ে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করেন। যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান বর্তমানে নাজুক, তাই বৈঠকের খবর গোপন রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে এ বৈঠকে আলোচনা হয়।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাকে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। এই আলোচনায় থাকা জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর ওই বছরের ৬ অক্টোবর গ্রেফতার হন সাবের হোসেন চৌধুরী। একটি হত্যা মামলাসহ ছয়টি মামলায়। যদিও পরবর্তী সময়ে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা দেশ ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে চলতি বছরের গত ১১ মে সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। কঠোর গোপনীয়তায় অনুষ্ঠিত পাঁচ মাস আগের ওই বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিয়ে সাবের হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরে আসতে পারে কীভাবে তা নিয়েই ওই বৈঠকে আলোচনা হয়। তবে সে সময় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ওই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে কিছু জানাতে না চাইলেও দাবি করেন, তারা সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যান, যা তাদের দীর্ঘদিনের অনুসরণীয় কূটনৈতিক রীতির অংশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও টালমাটাল। গত বছরের আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন, আর এর পর থেকেই তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব স্থান পেলেও নানামুখী রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে দেশে। অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় দলটি তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রমে আসতে পারছে না। এমন প্রেক্ষাপটের মধ্যেই সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তিন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের বৈঠকের ঘটনায় রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে।






