অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো অনেক দিন ধরেই উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছেন। এতে করে বিতর্কিত উপদেষ্টা কারা, কেন দলগুলো এমন অভিযোগ তুলছে- এসব প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সময় কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাকর্মীরা।
দলগুলো প্রতিপক্ষ দলকে জড়িয়ে এই অভিযোগ তুলছে। বিএনপির অভিযোগ, কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ দল বলতে তারা জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করছে। জামায়াতও একইভাবে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করে আসছে। অন্যদিকে এনসিপির অভিযোগ বিএনপি ও জামায়াতকে টার্গেট করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর ‘ভাগ-বাটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। গত দুই দিনে দল তিনটির নেতারা আলাদা আলাদাভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা গত মঙ্গলবার দেখা করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। সেই বৈঠকে তারা কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন। বিএনপির অভিযোগ, প্রশাসনে ও পুলিশে বদলি-পদায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে কাজ করছেন ওই উপদেষ্টারা।
প্রশাসনে রদবদল বা পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে চারজন উপদেষ্টা ও কেবিনেট বা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব রয়েছেন। বিএনপি নেতারা বলেছেন, ওই কেবিনেট কমিটি নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন তারা।
দলটির যে নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন, তাদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টার নাম তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন। বিএনপির সেই বিতর্কিতদের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি প্রশাসনে রদবদলের কেবিনেট কমিটিতে রয়েছেন। এই কমিটির আরেকজন সদস্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শেখ আব্দুর রশিদের নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধেও একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জানিয়েছে বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ওই মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার পরই তার অবস্থান। বিএনপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে খোদা বখস চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একটি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দিয়েছেন।
কোনো কোনো উপদেষ্টা রাজনীতি বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, এই অভিযোগও বিএনপি জানিয়েছে। এই অভিযোগের ক্ষেত্রে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের থাকা উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার দিকে আঙুল তুলেছে বিএনপি।
দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সরকারের যাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের ও কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তারা এনেছেন, তাদের যেন সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, এই আবেদনও তারা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
তবে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে দলগুলোর প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে কয়েকদিন আগে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছিলেন, যেহেতু বড় সব দলই অভিযোগ করছে, ফলে সরকার ঠিক পথে আছে বলে তিনি মনে করেন।
কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি বিএনপি বলেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুডে বা আদলে কাজ করবে বলে তারা চাইছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করবে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সেই আবেদন জানিয়েছেন তারা।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হবে সংসদ নির্বাচন। সেকারণে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো কাজ করবে, সেটাই তারা চান।
গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত ও এনসিপিও কিছু উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জামায়াতের অভিযোগ মূলত প্রশাসনে রদবদল ও পদায়ন নিয়ে। আর এক্ষেত্রে জামায়াত নেতারা বলেছেন, কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছেন। এই বিশেষ দল বলতে তাদের টার্গেট বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটির নায়েবে আমি সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। তিনি বলেছেন, তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে কোনো উপদেষ্টার নাম বলেননি।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তারা তাদের অভিযোগের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করলেন। প্রয়োজনে পরে তারা তাদের কাছে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করবেন।
তবে জামায়াতের অন্য একাধিক নেতার ইঙ্গিতে মনে হয়েছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন উপদেষ্টার ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে। সালেহউদ্দিন আহমেদ ওই জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর ‘ভাগ-বাটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
বিএনপি, জামায়াতের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এনসিপি নেতাদের এই সাক্ষাতের পেছনে ভিন্ন কারণ ছিল বলেও দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এই সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আর এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয় কি না, এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল।
এনসিপির সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সংখ্যা বা কলেবর বাড়ুক কিংবা কমুক, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই নির্বাচন হবে, এ ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সরকারের প্রভাবশালী দলগুলোর নজর প্রশাসনে। তারা স্ব স্ব দলের পক্ষে প্রশাসনে ও পুলিশে তাদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে। আর সেজন্য সরকার ও প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি বিভিন্ন অভিযোগ তুলছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা






