কবিতার নেপথ্যকথা : কাঙাল শাহীন | কলিকাল
মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫ ৩ আষাঢ় ১৪৩২ ২০ জিলহজ ১৪৪৬

মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২, ২০ জিলহজ ১৪৪৬

কবিতার আত্মবিশ্লেষণ

কবিতার নেপথ্যকথা : কাঙাল শাহীন

কাঙাল শাহীন

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫ | ১০:৩০ পিএম

কবিতার নেপথ্যকথা : কাঙাল শাহীন

ছবি : দৈনিক কলিকাল

ঘ্রাণের অদৃশ্য পুষ্প
—কাঙাল শাহীন

মনে হয়—
ফুল ফুটেছে কোথাও, কোনো অলক্ষ্য বাগানে,
যেখানে পাঁপড়িরা খুলে পড়ে নীরবে,
যেন নিঃশব্দ উচ্চারণে আত্মার গভীরে বাজে

কোনো চিরন্তন সুর।

চোখে পড়ে না কিছু—
না রঙ, না রেখা, না কোনো পুষ্পপত্রের ছায়া;
তবু এই নিশুতি রাতে
ঘ্রাণের গোপন তরঙ্গে কাঁপে বাতাসের কাঁধ।

এ কি তবে সেই অদেখা ফুল,
যে ফোটে না চোখের সামনে,
বরং হৃদয়ের অন্তঃপুরে জেগে থাকে—
যেমন কোনো স্মৃতি,
যার দাহ নেই, কিন্তু সুবাস অনির্বাণ?

না-কি এ রাত নিজেই রচেছে এক গন্ধময় ছদ্মবেশ,
যেখানে প্রতিটি নক্ষত্র একেকটি বর্ণহীন পুষ্প,
আর চাঁদের আলো—
কোনো অদৃশ্য মাধবীলতার বর্ণহীন গন্ধ?

হয়তো এ শুধু অনুভূতির অনুকাব্য,
যেখানে পংক্তির বদলে রয়েছে নিঃশ্বাস,
অক্ষরের বদলে প্রতিধ্বনি,
আর ব্যাখ্যার বদলে বিস্ময়।

ফুল কি ফুটেছে?
না ফুটলেও, যে ঘ্রাণ আসে—
তাতেই তো জানা যায়,
অদৃশ্য সৌন্দর্যই সবচেয়ে দৃশ্যমান।

…………………………………….

বিশ্লেষণের নিমিত্তে নিবেদন | সকল শিল্প আগুনের ঊর্ধ্বে যে অমৃত

কবিতা এক প্রকার গোপন আগুন— যা বাহ্যিকতাকে জ্বালায় না, কিন্তু অন্তর্জগতে নিঃশব্দ এক দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়।
কবিতা হয়তো কোনো সত্যকে সরাসরি বলে না, তবু তার নিঃশব্দ ইঙ্গিত আমাদের সেইসব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করা—
যেগুলো জীবনের সবচেয়ে গভীর স্তরে সুপ্ত হয়ে থাকে।

‘ঘ্রাণের অদৃশ্য পুষ্প’ কবিতাটি তেমনই এক সৃষ্টি,
যেখানে কবি কাঙাল শাহীন শব্দের ছায়ায় নির্মাণ করেছেন অনুভবের একটি লুকানো প্রাসাদ।

এই কবিতায় যা অনুপস্থিত, সেটিই সবচেয়ে বেশি বর্তমান।
যেখানে “ফুল ফুটেছে কি না”— সে প্রশ্ন নয় মূল কথা,
প্রধান হয়ে ওঠে অদৃশ্য সৌন্দর্যের অনুভূতি,
যা ঘ্রাণের মতো, থাকে— অথচ ধরা যায় না।

জার্মান দার্শনিক Martin Heidegger (মার্টিন হাইডেগার) বলেছিলেন—
“Poetry is the act of naming the gods.”
(“কবিতা হচ্ছে দেবতাদের নামকরণ করার প্রয়াস।”)

অর্থাৎ, কবিতা কেবল ভাষার খেলা নয়, বরং অস্তিত্বের গভীরতর স্তরে প্রবেশ করার একটি সাধনা।
এই কবিতায় সেই সাধনার ইঙ্গিত আছে—
যেখানে ফুল নেই, অথচ ঘ্রাণ আছে।
রূপ নেই, কিন্তু অনুভব ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।

ফরাসি কবি Paul Valéry (পল ভালেরি) বলেছিলেন—
“A poem is never finished, only abandoned.”
(“কোনো কবিতা কখনোই সম্পূর্ণ হয় না, কেবল পরিত্যক্ত হয়।”)

ঠিক সেই অর্থে এই কবিতাও একটি চূড়ান্ত অসমাপ্তির সৌন্দর্য— যে সৌন্দর্য পাঠকের হৃদয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ হয়।
এ যেন এক অন্তঃশব্দের সুর,
যা বাইরে উচ্চারিত না হলেও, ভেতরে অনুরণিত হয় বহুদিন ধরে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবুও অনন্ত আনন্দ, তবুও আমারে তুমি অনন্ত করেছো…”

এই “তবুও”-র মধ্যেই কবিতার চিরন্তন অবস্থান।
তবুও ফুল ফুটে ওঠে, তবুও ঘ্রাণ আসে,
তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে— এটাই কবিতার অমরতা।

গ্রীক দার্শনিক Plato (প্লেটো)-র বিশ্বাস ছিল,
শিল্প হচ্ছে অনুকরণের অনুকরণ (mimesis of a mimesis)।
তবু শিল্পই কালজয়ী হয়— কারণ, সব অনুকরণের মধ্যেও এক “অসীমের অভিপ্রায়” কাজ করে।

‘ঘ্রাণের অদৃশ্য পুষ্প’ সেই অসীমেরই এক ছোট্ট, কিন্তু সূক্ষ্ম অনুধ্যান।

এই কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়— সৌন্দর্য কেবল দৃশ্য নয়, কেবল উপস্থিতিও নয়, সৌন্দর্য অনেক সময় অনুপস্থিতির গভীরতম ব্যঞ্জনায় নিজেকে উন্মোচন করে।

এই কবিতার জন্য কবি নিজেই লিখেছেন এক স্বকীয় পাঠভাষ্য— যা পাঠককে আরও এক ধাপে নিয়ে যায় কবিতার অন্তর্জগতে প্রবেশের পথে।

আমরা বিশ্বাস করি, এই কবিতা ও পাঠভাষ্য পাঠকের চিন্তা ও অনুভবকে উসকে দেবে, জাগিয়ে তুলবে সেইসব প্রশ্ন—
যার উত্তর হয়তো কোনোদিন পুরোপুরি মেলে না,
তবু যেগুলোর খোঁজেই কবিতা চিরকাল বেঁচে থাকে।

সব শিল্প একদিন আগুন পেরিয়ে অমৃত হয়—
এই বিশ্বাসেই আমরা কবির এই নিঃশব্দ অনুরণনকে প্রকাশ করছি, যেন পাঠকের হৃদয়ে জেগে ওঠে একটি অদৃশ্য, অথচ চিরস্মরণীয় পুষ্প।

মন্তব্য করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

Archive Calendar

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930