আজ লাখো স্বজন হারানোর শোকাবহ ২৯ এপ্রিল | কলিকাল
রবিবার ২২ জুন ২০২৫ ৮ আষাঢ় ১৪৩২ ২৫ জিলহজ ১৪৪৬

রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২, ২৫ জিলহজ ১৪৪৬

আজ লাখো স্বজন হারানোর শোকাবহ ২৯ এপ্রিল

কলিকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ৯:৫৯ এএম

আজ লাখো স্বজন হারানোর শোকাবহ ২৯ এপ্রিল

ছবি : সংগৃহীত

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ছিল অন্ধকার ও বিভীষিকাময় রাত। আজ সেই ২৯ এপ্রিল উপকূলের স্বজন হারানোর বেদনাদায়ক দিন। দেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল এই দিনে।

১৯৯১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে সুপার সাইক্লোনে রূপ নেয়। ২৯ এপ্রিল রাত ৮ টা থেকে ১২টার মধ্যে এটি ‘ক্যাটাগরি-৫’ মাত্রার ঘুর্ণিঝড় হিসেবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার, সঙ্গে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। এই জলোচ্ছ্বাস নিম্নাঞ্চলীয় ও চরাঞ্চলগুলোকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেয় এবং বহু মানুষ ঘরের ভেতরেই প্রাণ হারান।

ঘুর্ণিঝড়টি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তাণ্ডব চালায় এবং কোটি মানুষের জীবনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ঘুর্ণিঝড়টি সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা ও লক্ষ্মীপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে। উপকূলবর্তী চরাঞ্চল, দ্বীপ ও বাঁধবিহীন এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা পানির নিচে চলে যায়। বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়ায় ঘরবাড়ি ধ্বংস ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়।

কক্সবাজার জেলার মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপ উপজেলা হওয়ায় ২০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে পুরো অঞ্চল ভেসে যায়। চকরিয়া, পেকুয়ার বহু গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে অনেক মানুষ নিখোঁজ হন।

এছাড়া উপকূলের ১৯ টি জেলা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চরমভাবে দেখা দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেলেও এই সংখ্যা দুই লক্ষের কাছাকাছি বলে দাবি করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম। অনেক মানুষ নিখোঁজ ছিল এবং বহু মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। প্রায় ১০ লক্ষ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। প্রায় ১৫ লক্ষ একর ফসলি জমি ধ্বংস হয়। লক্ষাধিক গবাদিপশু মারা যায়। শত শত স্কুল, মসজিদ, ক্লিনিক ভেঙে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শিশুদের জন্য দুধ, ওষুধ ও খাবার ছিল অনুপলব্ধ।

সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের ২৬ এপ্রিল থেকেই চলছিল ঝড়-বৃষ্টি। এরই মাঝে সংকেত কেবল বাড়ছিল। অভিজ্ঞতা না থাকায় বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছ্বাস আমার রক্তের বন্ধনগুলো ভাসিয়ে নিয়েছে। প্রায় ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস বাবা-মা, ভাই-বোনদের হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেয়। তাদের মরদেহ পর্যন্ত দেখার সুযোগ হয়নি। ৩৫টি বছর কেটেছে প্রতিদিন তাদের মনে পড়ে, তবে ২৯ এপ্রিল এলেই হারানো স্বজনদের স্মৃতি বেশি নাড়া দেয়। কষ্ট ভুলতে এলাকা ছাড়লেও চারপাশে তাদের স্মৃতি লেপটে আছে।

শুধু মোহাম্মদ হোসেন নন, উপকূলের শত শত মানুষ তার মতো আপনজনদের হারিয়ে এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। ৩৫ বছর পেছনে ফেলে এসেছেন, কিন্তু হারানোর বেদনা তাদের কখনো নিস্তার দেয় না। এদিনে ভারাক্রান্ত মনে উপকূলবাসী তাদের হারানো স্বজনদের স্মরণ করছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, উপকূল অঞ্চল মিলিয়ে জেলায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৫ শতাধিক ছাড়িয়েছে। আগের সাইক্লোন শেল্টারে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া শেল্টারের স্থলে নতুন করে স্থাপন হয়েছে। মানুষও এখন অনেক সচেতন। দুর্যোগের আভাস পেলে প্রশাসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সময়মতো আশ্রয় কেন্দ্রে যান। ফলে আগের মতো ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে।

মন্তব্য করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

Archive Calendar

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930